হরতাল কি, কেনো, ইতিহাস, পরিসংখ্যান ও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হরতালের আদ্যপান্ত।
বিগত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিসংখ্যান এবং বর্তমান অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিএনপির ঘোষিত একদিনের হরতালে দেশের অর্থনীতিতে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। সময় সংবাদ-২৯/২৩
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (ডিসিসিআই) ২০১৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, সে সময়ে একদিনের হরতালে পোশাকখাত, পরিবহনখাত, পাইকারি-খুচরা ব্যবসা, আমদানি-রফতানি ও রাজস্ব আয় মিলিয়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বা ২০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হতো। সময় সংবাদ- ২৯/২৩
২০১৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ১১ লাখ কোটি টাকা। যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ কোটি টাকা। অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হরতালে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে একদিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। সময় সংবাদ- ২৯/২৩
জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত দেশে প্রায় এক হাজার ৭০০ দিন অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার বছরই হরতাল ছিল ।-দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস
১৯৯১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হরতাল সহিঞ্চুতায় অগ্নিদগদ্ধ, বিস্ফোরনসহ কয়েকটি কারণে সর্বমোট ২৭৮৮ জন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে অন্তত ৫ হাজারেরও অধিক মানুষ।
ওইকিপিডিয়ার তথ্যমতে হরতাল শব্দটি মূলত একটা গুজরাটি শব্দ থেকে এসেছে। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন।এটা হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত আন্দোলন। হরতালের সময় সকল কর্মক্ষেত্র, দোকান, আদালত বন্ধ থাকে। তবে সাধারণত এ্যাম্বুলেন্স, দমকলবাহিনী, গণমাধ্যমসমূহ এর আওতার বাইরে হয়ে থাকে।
ষাটের দশক থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে হরতালকেই ধর্মঘটের চেয়ে অধিকতর জোরদার মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে গণমানুষকে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে হরতাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৮০-র দশকে হরতাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে একটি বহুল ব্যবহৃত কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিরোধী দলসমূহ জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ-এর শাসনকে (১৯৮২-৯১) অবৈধ ঘোষণা করে ঘন ঘন হরতাল ডেকে প্রশাসনকে অকেজো করে দেয় এবং তাঁর সরকারের পতন ঘটে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলসমূহ বেগম খালেদা জিয়ার সরকারকে (১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬) উপর্যুপরি হরতালের মাধ্যমে তীব্র চাপে রাখে। শেখ হাসিনার প্রশাসনও (১৯৯৬-২০০১) হরতালের চাপ থেকে মুক্ত ছিল না।
১৯৭১ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে সাত দিন এবং ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ১৭ দিন গড়ে হরতাল হয়েছে। আর গণতান্ত্রিক সরকার আসার পর ১৯৯১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৪৬ দিন করে হরতাল হয়েছে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪৭ দিন জাতীয়ভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। এর বেশির ভাগ হরতাল হয়েছে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা থেকে শুরু করে ১৯৭০ সালের মার্চ পর্যন্ত।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত জাতীয় হরতাল হয়েছে মাত্র পাঁচ দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত দেশে ছয়টি হরতাল পালিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে হরতালের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর। ১৯৮২ সালের মার্চ থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭২ দিন জাতীয়ভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের অভিযোগে ১৪ সেপ্টেম্বর হরতাল পালন করে আওয়ামী লীগ। সেই থেকে আবার হরতাল কর্মসূচির শুরু।
১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে শুরু হয় টানা হরতাল। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ২১ বার হরতাল পালন করা হয়। আর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টানা ৩৯ দিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলে। ১৯৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে ৮১ দিন জাতীয়ভাবে হরতাল হয়েছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ সালের মার্চ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপি ৪৫ দিন হরতাল করেছে। ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিরোধী দলে আওয়ামী লীগ সব মিলিয়ে ১৩০ দিন হরতাল করেছে। আর ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৭০ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরেই ৪০ দিন ছিল হরতাল।
সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ৪৫৯ দিন হরতাল হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল থাকার সময়ে দুই আমলে মোট হরতাল করেছে ২০১ দিন, আর বিএনপি করেছে ৮৫ দিন। কেবল জাতীভাবে নয়, দেশে স্থানীয়ভাবেও অনেক হরতাল পালিত হয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে ধরলে স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত দেশে প্রায় এক হাজার ৭০০ দিন অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার বছরই হরতাল ছিল দেশে।
১৯৯০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে ৮১ দিন জাতীয়ভাবে হরতাল হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ সালের মার্চ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপি ৪৫ দিন হরতাল করেছে।
২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিরোধী দলে আওয়ামী লীগ সব মিলিয়ে ১৩০ দিন হরতাল করেছে। আর ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৭০ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরেই ৪০ দিন ছিল হরতাল।
প্রায় চার বছর পর সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জিং সময়ে ঘোষিত হরতালের কারণে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মত অর্থনীতিবিদদের।
এর আগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে টানা ৬দিন চলা হরতাল নিয়ে জাতিসংঘের উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তখনকার ৬ দিনের হরতালে দেশের ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। প্রতিটি হরতালে জিডিপির গড় ক্ষতি ছিল সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।
একই প্রতিবেদনে বলা হয়, হরতালের কারণে দেশের মোট অর্থনীতির ২০ শতাংশ ক্ষতির মুখে পড়ে। এছাড়া আমদানি-রফতানিতে এ ক্ষতির পরিমাণ ১০ শতাংশ এবং শুধু একদিনের হরতালের কারণে দেশে পণ্যমূল্যের দাম বাড়ে ১০ শতাংশ।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, ১৯৯১-৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক সহিংসাতায় ১৭৪ জন মারা যায়। ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের প্রথম শাসনামলে মারা যায় ৭৬৭ জন মানুষ। বিএনপি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১-২০০৭ সালে হরতাল সহ অন্যান্য কারণে মৃত্যুবরণ করে ৮৭১ জন। তত্বাবধায়ক আমলে ২০০৭-০৮ সালে মারা যায় ১১ জন। এবার আওয়ামী লীগ আমলে ২০০৯ থেকে ৮ নভেম্বর ২০১৩ সাল পর্যন্ত মারা গেছে ৫৬৪ জন। হরতালের সহিংসাতায় ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১০ দিনে নিহত হয়েছে ২৭ জন, আহত হয়েছে একা হাজারেরও বেশি। ককটেল, পেট্রোল বোমায় অগ্নিদদ্ধ হয়েছে ৭৬ জন। এদের মধ্যে ১৩ শিশু ও তিনজন প্রতিবন্ধী রয়েছে। শুধু আগুনে পুড়েই মারা গেছে ৬ জন। ৪৯০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। দেড় হাজারের বেশি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং উদ্ধার হয়েছে আট শতাধিক- দৈনিক সকালে খবর ১৭ নভেম্বর ২০১৩।
সবশেষে বলতে চাই
হরতালে নির্দেশ দাতাদের চাইতে নির্দোশ মানুষজন ক্ষতিগ্রস্থ ও দূর্ঘটনার শিকার হয় বেশি। তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থে হরতাল কর্মসূচী যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
আস্সালামো আলাইকুম….
إرسال تعليق
Please do not enter any spam link in the comment box.