দেশের বাইরে বাংলাদেশি এমপির নজিরবিহীন খু'ন | MP Anwarul Azim


একে একে জট খুলছে হত্যা রহস্যের। উন্মোচন হচ্ছে চাঞ্চল্যকর তথ্যের। বাংলাদেশের কোন এমপির পাশের দেশ ভারতে গিয়ে এমন খুনের ঘটনা নজিরবিহীন। দন্ডের জেরে বিশ্বস্ত বন্ধুই ছোবল মারল বন্ধুকে।  লাশ টুকরো টুকরো করে গায়েব করা হয়েছে শরীরের এক একটি খণ্ডাংশ। এমনভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছে যা খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনারুল আজিম আনারের লোমহর্ষ হত্যার কাহিনী এখন টক অফ দা কান্ট্রি। পাশের দেশ ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যকে ভারতে কেন হত্যা করা হবে তা নিয়ে দানা বেঁধেছে নানান সন্দেহ। এ বিষয় নিয়ে আজকের আলোচনা- 


লাশ এখনো না মিললেও কলকাতায় বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনারুল আজিম আনার যে খুন হয়েছেন তা বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের কর্মকর্তাদের তরফে বলা হচ্ছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে মাত্র ৮ ঘণ্টায় কিলিং স্কোয়াড মিশন সম্পন্ন করা হয়। মেরে ফেলা হয় শ্বাস রোধ করে। এরপর লাশকে অসংখ্য খন্ড খন্ড করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন জায়গায় যার হদিস মেলা দুষ্কর। খন্ডিত মরদেহ উদ্ধারের সম্ভাবনা যে কম। আর গ্রেফতারকৃত আসামীরাও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কলকাতা ট্রিপ্লেক্স ফ্ল্যাটে খুনের পর লাশ টুকরো করে হলুদ আর মসলা দিয়ে মেখে সরানো হয় ট্রলিতে। আর এ কারণেই মরদেহ উদ্ধারের সম্ভাবনা ও কম। এরপরও কিছু লাশের টুকরো উদ্ধারে আপ্রাণ চেষ্টায় দু’দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। তাহলে বুঝতেই পারছেন কতটা সতর্কতা বসত দুর্ধর্ষভাবে কিলিং মিশন সম্পূর্ণ করা হয়েছে।


১২ মে চিকিৎসার জন্য চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যাওয়ার পর থেকে এমপি আনোয়ারুল আজিমের নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে জট বাধতে শুরু করে সন্দেহ। সেদিনের কয়েক সেকেন্ডের একটি ভিডিওকে ঘিরেই কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে।

 

প্রশ্ন নম্বর-১: একজন সংসদ সদস্য কেন সঙ্গীহীনভাবে ভারতে এলেন?

প্রশ্ন নম্বর-২: তার সঙ্গে কেন মাত্র একটি হ্যান্ডব্যাগ ছিল?

প্রশ্ন নম্বর-৩: সীমান্ত অতিক্রম করার সময় কে ধারণ করল এক মিনিটের ভিডিও?

প্রশ্ন নম্বর ৪: কার গাড়িতে বরানগর থেকে উঠে এলেন এমপি আনার?

প্রশ্ন নম্বর-৫: ফোনে কথা না বলে যে খুদে বার্তা দিলেন সেটা কি আদৌ তার লেখা?

প্রশ্ন নম্বর-৬: সন্দেহ জাগে আট দিন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মাত্র দুদিন মোবাইলের লোকেশন ট্র্যাক করা সম্ভব হয়, পরে হঠাৎ কেন ট্রাক করা যাচ্ছে না? 


সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি মনে সন্দেহ জাগে সেটি হলো চলমান নির্বাচনের সময় হঠাৎ কেন ভারতে এসেছিলেন তিনি? এমপির এমন যাত্রায় দায়িত্বশীলরা অনেকে মিস্টেরিয়া হিসেবে দেখা শুরু করেন। নিখোঁজের পর দুটো মোবাইলের লোকেশন ট্র্যাক করে প্রথম দুদিন বিভ্রান্ত হন গোয়েন্দারা। বাংলাদেশের নাম্বারটি বেনাপোল এলাকায় দেখায় এবং ভারতীয় নম্বরটি বিহারের মুজাফফরপুর এলাকায় দেখায়। এরপর থেকে ওই দুই নম্বরের লোকেশন আর ট্রাক করা যায়নি। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট বলছে স্বর্ণ চরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। এজন্য গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে কলকাতার সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। সেই স্বর্ণ চুরাচালানের আন্ত-দেশীয় কোন কোন্দলের জেরে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। এজন্য পাতা হয়েছিল নারীর ফাঁদ।


শিলাস্তি রহমান

সন্দেহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর! আর সেখানে হানি ট্র্যাপের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় তরুণী শিলাস্তি রহমানকে। জানা যায় এই নারী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহিনের বান্ধবী। ভারত আসা যাওয়ার সুবাদে সেখানে খুন করতে নেয়া হয় সঞ্জিবা গার্ডেনের এই ফ্ল্যাটটিতে। আর সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। এজন্য দু তিন মাস আগে থেকেই পরিকল্পনার ছক করা হয়। এমনকি মূল হোতা আখতারুজ্জামান শাহিনের বাংলাদেশের গুলশান ও বসুন্ধরা থাকা দুটি ফ্ল্যাটেও এ নিয়ে একাধিকবার বৈঠক করা হয়।


পরিকল্পনা মোতাবেক মূল হত্যাকারী শিমুল ভূঁইয়া তার সহযোগি তানভীর ভূইয়া এবং শাহিনের গার্লফ্রেন্ড শিলিস্তা রহমান এপ্রিলে ৩০ তারিখ কলকাতায় যান। কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়া মূল হত্যাকারী হলেও তিনি আমানুল্লাহ আমার নামে নতুন একটি পাসপোর্ট করে ভারতে যান। ব্যবসায়ীক দন্দের হত্যার পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আক্তারুজ্জামান শাহীন, যিনি আনোয়ারের বাল্যবন্ধু ও ব্যবসায়ী পার্টনার। ঘটনার পর পরই গা ঢাকা দিয়ে পারিজমান যুক্তরাষ্ট্রে। ১২ মে এমপি আনার কলকাতায় পৌঁছার পরদিনই ১৩ তারিখে কলকাতার সঞ্জিবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে নিয়ে হত্যায় সম্পূর্ণ করা হয়। প্রতিবেশী দেশের সংসদ সদস্যের খুনের ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করে ভারতীয় পুলিশ। দেশটির গোয়েন্দাদের দাবি এমপি আনার কে হত্যার পর ছিন্ন ভিন্ন দেহ তিনটি ট্রলি বেগে করে ফ্ল্যাট থেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা। 


সঞ্জিবা গার্ডেন


এমপি আনারকে কিলিং মিশনের পরিকল্পনা নিয়ে গোয়েন্দা তথ্য বলছে গত ৩০ এপ্রিল আখতারুজ্জামান শাহিন চরমপন্থী নেতা আমান ও সেলিস্তা রহমান নামে নিজের এক বান্ধবীকে নিয়ে কলকাতায় যান। সেখানে আগে থেকে ভাড়া করে রাখা নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা। কলকাতায় আরো আগে থেকেই অবস্থান করছিল শাহিনের দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদ। হত্যার পুরো দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে ১০ মে দেশে চলে আসেন শাহীন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমান বাংলাদেশ থেকে আরও ভাড়াটে কিলার কে নিয়ে যায় কলকাতায়। ফয়সাল গাজী ও মুস্তাফিজ নামে দুই ভাড়াটে খুনি ১১ মে কলকাতায় গিয়ে আমানের সঙ্গে যোগ দেয়। জানা গেছে ১২ মে চিকিৎসার জন্য চুয়াডাঙ্গার দর্শনার সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান ঝিনাইদহ ৪ আসনের সংসদ সদস্য আনারুল আজিম আনার। প্রথম দিন তিনি তার বন্ধু গোপালের বাসায় থাকেন। পর দিন ১৩ মে কৌশলে এমপি আনারকে নিউটাউনের সেই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন এর সামনে এমপি আনার ও তার একসঙ্গে কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর তাদের সামনে সুজুকি লাল রঙের একটি সুইফট মডেলের কার এসে থামে। পরে গাড়ি থেকে আরেকজন ব্যক্তি নেমে এসে আনারস সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনজন  গাড়িটিতে করে চলে যান। অপর একটি ফুটেজে ওই গাড়িটিকে সড়ক ধরে চলে যেতে দেখা যায়। সিসিটিভি ফুটেছে দেখা গেছে এমপি আনারকে সঞ্জিবা গার্ডেনের যে ফ্লাটে হত্যা করা হয় সেখানে তিনি ছাড়াও আরো তিনজন ঢুকেছিলেন। তার মধ্যে একজন নারীও ছিলেন। এই তিনজনকে আবার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়।


এছাড়া ঐ ফ্ল্যাটে ঢোকার জন্য তড়িঘড়ি করে একটি গাড়ি ও কয়েকবার আসা-যাওয়া করে। লাল রঙের গাড়িটি জব্দ করেছে দেশটির পুলিশ। গোয়েন্দা সূত্রে দাবি চাপাতির মুখে আনার কে জিম্মি করে আমান তার সহযোগী ফয়সাল মোস্তাফিজ শ্রীরাম ও জিহাদ। এ সময় তারা এমপির কাছে শাহিনের পাওনা টাকা পরিষদের কথাও বলে। বিষয়টি নিয়ে তরকা তুর্কির একপর্যায়ে সবাই মিলে আনার কে জাপটে ধরে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর মোবাইলে শাহিনকে বিষয়টি জানায় আমান। পরিকল্পনামাফিক লাশ গুম করতে এমপি আনারকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর ফ্ল্যাটের কাছে শপিংমল থেকে আনা হয় দুটো বড় ট্রলিব্যাগ ও পলিথিন। এমপি আনারের মরদেহের টুকরো গুলো পলিথিনে পেচিয়ে ট্রলি ব্যাগে ভরা হয়। ঘটনার রাতে লাশের টুকরোসহ দুটি ট্রলিব্যাগ বাসাতেই রাখা হয়। এর মধ্যে তারা বাইরে থেকে ব্লিচিং পাউডার এনে ঘরের রক্তের দাগ পরিষ্কার করে।


গোয়েন্দারা জানাচ্ছে হত্যাকাণ্ডের পর দিন বিকালে একটি ট্রলি ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হয় আমান। পাশের শপিং মলের সামনে সেই ট্রলি ব্যাগটি সিয়ামের হাতে তুলে দেয়। সিয়াম সেই ব্যাগ নিয়ে তাদের আগে থেকে ভাড়া করে রাখা গাড়ি নিয়ে অজ্ঞাত স্থানের দিকে চলে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর ব্যাগটি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সিয়াম। আমানের নির্দেশনা অনুযায়ী তার দুই সহযোগী এমপি আনারের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন নিয়ে দুই দিকে চলে যায়। সেখানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করার পাশাপাশি বিভিন্ন নম্বরের টেস্ট করা হয়। এতে তদন্তকারী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমপি আনারের অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্ত হবে এমনটা ধারণা ছিল তাদের। এরপর ১৫ মে সিলিস্তাকে তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে আমান। পরে ১৭ মে মুস্তাফিজ ও ১৮ মে ফয়সাল বাংলাদেশে ফেরত আসে বলে গোয়েন্দা সূত্র দাবি জানিয়েছে।


৫ কোটি টাকার চুক্তি কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার পর ঢাকার মোহাম্মদপুরে বোনের বাসায় আত্মগোপনে ছিল চরমপন্থী আমান। বিভিন্ন সূত্র বলছে আমানের পুরো নাম আমানুল্লাহ সায়েদ। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। তিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন। ১৯৯১ সালে যশোরের অভয়নগর এলাকায় গণেশ নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০০ সালে আবারও একজনকে হত্যার দায়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি ছিলেন। জামিনে কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি ভাড়াটে কিলার হিসেবে কাজ করতেন বলে দাবি গোয়েন্দাদের। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ, ফয়সাল ও মাস্টারমাইন শাহিনের বান্ধবীর সিলিস্তা রহমানকে ঢাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের জোবায়ের নামে একজনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাব চালককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। হত্যার রহস্য উদঘাটনে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও কলকাতা পুলিশ সহ কয়েকটি টিম কাজ করছে। এদিকে আনারুল আজিম হত্যার ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বন্ধু শাহীনের নাম উঠে আসার পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব অপরাধের তথ্য। ঝিনাইদহের পটচাঁদপুরে স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, হত্যা, হয়রানি সহ নানা অপকর্মের বছরে পর বছর প্রভাব বিস্তার করেছেন তিনি। এতদিন যারা মুখ খুলতে সাহস পাননি নির্যাতনের শিকার হওয়া সেইসব স্থানীয়রা বলছেন এমন সব অভিযোগ।



Post a Comment

Please do not enter any spam link in the comment box.

أحدث أقدم